‘এই ভবনটি সিসি ক্যামেরা দ্বারা সার্বক্ষণিক করা হচ্ছে...।’ এখন অনেক বাড়ি, অফিস বা ভবনে এমন সতর্কবার্তা টাঙানো। কেউ যাতে কোনো দুষ্কর্ম করার আগে একবার অন্তত ভেবে দেখে যে তাঁর কার্যক্রম নজরদারি করা হচ্ছে। সে কারণেই সিসিটিভি। ভিডিওর মাধ্যমে নজরদারির ব্যবস্থায় (সার্ভিলেন্স সিস্টেম) সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন) ক্যামেরা এখন বেশ পরিচিত। বিশেষ করে নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরার চাহিদাও বাড়ছে। বাইরে তো বটেই, কর্মজীবী দম্পতি, যাঁদের শিশুসন্তানকে বাসায় কারও কাছে রেখে আসতে হয়, তাঁরাও বাসার ভেতরে নির্দিষ্ট কিছু স্থানে সিসি ক্যামেরা বসান। ফলে দূর থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাসার ওপর নজরদারি রাখা যায়।

একটু খেয়াল করে দেখবেন, বাসায় ঢোকার মুখে বা ভবনের কোথাও না কোথাও গোলাকার একধরনের ক্যামেরা বসানো। এটা মূলত ডোম ক্যামেরা। এ ক্যামেরায় চারপাশের সব ঘটনা ও কার্যক্রম ধারণ হতে থাকে। বাজারে ডোম ক্যামেরা ছাড়াও বুলেট, ডল, ফিশ আই ভিশনসহ নানা রকম সিসি ক্যামেরা রয়েছে।

ঢাকার বাজারে দেখা গেল মূলত দুই রকম ক্যামেরার চাহিদা বেশি। ডোম ও বুলেট। ডোম ক্যামেরা সাধারণত আর্চওয়ে বা যেখানে লোকজন যাতায়াত করে, সেখানে বসানো হয়। এর বাইরে রয়েছে দেয়ালে বসানোর জন্য উপযোগী বুলেট ক্যামেরা। ছোট ছোট যন্ত্রে ডল ক্যামেরা বসানো থাকে। বিস্তারিত বা বেশি জায়গাজুড়ে দেখার জন্য ফিশআই ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। এসব যন্ত্রের দামও হাতের নাগালে। এটা লাগানোও খুব সহজ। সেটআপ করে দেওয়ার জন্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। চাইলে একটি কক্ষে ছোট আকারের ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ যেমন আছে, তেমনি বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্য নিরাপত্তা সিস্টেম হিসেবে সিসিটিভি যুক্ত করার প্রকল্পও রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে নিরাপত্তা পণ্যের বাজার বড় হচ্ছে। বিশেষ করে সিসিটিভির চাহিদা বাড়ছে। ২০১৩ সাল থেকে এর বাজার বাড়তে শুরু করে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে বছরে দুই থেকে আড়াই লাখ সিসিটিভির চাহিদা রয়েছে।

বাণিজ্যিকভাবে চল্লিশের দশকের পর থেকে সিসিটিভির ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৪২ সালে জার্মানিতে প্রথম সিসিটিভি দেখা গেছে। এটি তৈরি করে সিমেন্স এজি। রেকর্ডিং তারের মাধ্যমে বা পিয়ার টু পিয়ার (স্বাধীন গ্রাহক থেকে গ্রাহকের মধ্যে যোগাযোগ) তারহীন যোগাযোগের মাধ্যমে সম্প্রচার করার সুবিধা ছিল। সেই সময়কার সিসিটিভির সঙ্গে আধুনিক কালের সিসিটিভির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য চোখে পড়ে। আধুনিক সিসিটিভি নেটওয়ার্কে নজরদারির কাজের জন্য একসঙ্গে একাধিক ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে ব্যাংক থেকে শুরু করে রাস্তা, অফিস, দোকান এমনকি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য বাড়িতেও সিসিটিভি বসানো হচ্ছে।

আধুনিক সিসিটিভি কীভাবে কাজ করে? দেশে নিরাপত্তা পণ্য বিপণন প্রতিষ্ঠান সিস্টেমআই টেকনোলজিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল আহমেদ বলেন, নিরাপত্তা ক্যামেরার সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে সরাসরি চলে এ পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম। ক্যামেরায় ধারণ করা চলমান ছবি মনিটরে দেখা যায় সরাসরি। পুরো কার্যক্রমটি পরিচালিত হয় সফটওয়্যারের মাধ্যমে। সাধারণত সিসিটিভি শুধু তথ্য সংরক্ষণ করে, যা পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন হলে ব্যবহার করা হয়। বর্তমান সময়ে ‘রিয়েল টাইম সার্ভিলেন্স মনিটরিং’ নামে আরও উন্নত ব্যবস্থাও ব্যবহৃত হচ্ছে। এ কার্যক্রমে নিরাপত্তার বিষয়টি যে কেউ তাৎক্ষণিকভাবে দেখতে পারেন। চাইলে নিজের স্মার্টফোন কিংবা ট্যাবলেট থেকেও অ্যাপের মাধ্যমে নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা সম্ভব।

এক্সেল টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গৌতম সাহা বলেন, গত কয়েক বছরে দেশে সিসিটিভির চাহিদা অনেক বেড়েছে। এখন কম খরচেই নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি সেট করা যায়। তাই অনেকেই এ সুবিধা নিচ্ছেন। নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন সবাই। সিসিটিভির সঙ্গে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির চাহিদাও বাড়ছে। ডিভিআর, স্টোরেজ, কেবল ও মনিটরের বিক্রি বেড়ে গেছে। গ্লোবাল ব্র্যান্ডের সিকিউরিটি অ্যান্ড সার্ভিলেন্স জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক জুবায়ের হোসেন বলেন, সিসিটিভির পূর্ণাঙ্গ প্রযুক্তি সমাধানের চাহিদা রয়েছে। অনেকেই নিরাপত্তার কথা ভেবে ক্যামেরা কিনছেন। গ্লোবালের কাছে দুই হাজার থেকে দুই লাখ টাকা দামের ক্যামেরা রয়েছে। একেক ক্যামেরার কার্যক্ষমতা একেক রকম। সাধারণত চার ক্যামেরা, আট ক্যামেরা সিস্টেম হিসেবে সেটআপ করা হয়।

টেকনোলজিসের সিকিউরিটি অ্যান্ড সার্ভিলেন্স সিস্টেমের ব্যবস্থাপক রনি সাহা বলেন, প্রতি মাসে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার সিসিটিভির চাহিদা রয়েছে এখন। শুধু ঢাকা নয়, দেশের জেলায় এ ধরনের পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। অ্যানালগ ক্যামেরা আর আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) দুই ধরনের ক্যামেরার চাহিদা রয়েছে।

রাজধানীর সিসি ক্যামেরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ক্যামেরা মিউজিয়ামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ গাফফার মোল্লা বলেন, সিসি ক্যামেরার বিক্রি এখন মোটামুটি ভালো। এখন অনেকেই বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে সিসিটিভি লাগাচ্ছেন। ব্র্যান্ড বা নন–ব্র্যান্ড সব ধরনের পণ্যের খোঁজ করছেন ক্রেতা। ক্যামেরাগুলোর বেশির ভাগই চীন ও তাইওয়ান থেকে আসছে।

বাজারে হিকভিশন, প্যানাসনিক, বোস, লিলিন, ডাহুয়া থেকে শুরু করে নানা রকম চীনা ও তাইওয়ানিজ ব্র্যান্ডের ক্যামেরা পাওয়া যায়। বাজারের ৯০ শতাংশের বেশি পণ্য চীনে তৈরি।


দাম

সিসিটিভি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও বাজারের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে আড়াই লাখ টাকা দামের সিসি ক্যামেরা আছে। এ ছাড়া এই ক্যামেরার তথ্য সংরক্ষণ করতে নানা যন্ত্রপাতি কিনতে হয়। এর মধ্যে ডিভিআরসহ চার ক্যামেরা সেটআপে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা খরচ পড়ে। সাধারণত ৪, ৮, ১২ ক্যামেরা হিসেবে সেটআপ করা হয়। একটি মনিটরে কয়েকটি ক্যামেরার ছবি দেখা সম্ভব। মনিটর, স্টোরেজ, ডিভিআর আলাদা কিনতে হয়। এ ক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী দামের হেরফের হয়। একেক প্রতিষ্ঠানের ইনস্টল করার খরচ একেক রকম।


কোথায় পাবেন

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রযুক্তিপণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে সিসিটিভি ক্যামেরা পাবেন। রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদ, স্টেডিয়াম মার্কেট, বসুন্ধরা সিটি, ধানমন্ডি, বনানী, কম্পিউটার সিটিসহ বড় বড় কয়েকটি শপিং সেন্টারে সিসি ক্যামেরার দোকান পাবেন।


সোর্সঃ প্রথম আলো